সংবাদচর্চা রিপোর্ট
বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যে উত্তপ্ত নারায়ণগঞ্জ শহর। সমসাময়িক সকল বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই আলোচনা সমালোচনা চলছে পুরো শহরজুড়ে। নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদের যোগদানের পরপরই যত অবৈধ কর্মকান্ড তথা অবৈধ স্ট্যান্ড, মাদক ব্যবসায়ী ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। যে সময় নগরবাসীর স্বার্থে এসপি হারুন কাজ করে যাচ্ছেন ঠিক সে সময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে একটি কুচক্রী মহল। যার ন্যায় কিছু দিন আগে চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান খালেদ হায়দার খান কাজল জেলার বেশ কিছু ব্যবসায়ীদের নিয়ে শহর অচল করে দেয়ার হুঙ্কার প্রদান করেন।
এর ঠিক পরপরই পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ শহরে জেলার প্রশাসন নিয়ে সড়কে মহড়া দেন। সর্বশেষ আবার মুখ খুললেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। তিনি আকারে ইঙ্গিতে প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করেন। সমসাময়িক এসকল বিষয়বস্তু নিয়ে নগরবাসী আগেই টের পান যে শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। যার ন্যায় গতকাল শনিবার শামীম ওসমানের জরুরী কর্মীসভা চলাকালীন পুরো শহর হঠাৎ করেই ফাকাঁ হয়ে যায়।
প্রভাবশালী নেতার শেল্টারে থাকা কিছু কতিপয় ব্যক্তিদ্বয় প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্যে প্রদান করে থাকেন। ধারাবাহিকভাবে প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলে একের পর এক বক্তব্য প্রদান করছেন অতিরিক্ত ক্ষমতাবান নেতারা। কিন্তু সেই বক্তব্যের কোন তোয়াক্কা না করে প্রশাসন তার গতিতেই ছুটে চলেছেন। কারণ নারায়ণগঞ্জের বর্তমান পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ। যিনি আসার পর থেকেই অশান্ত নারায়ণগঞ্জ ধীরে ধীরে শান্ত হতে চলেছে। কিন্তু এসপির এই ভালো কাজের বাহবা না দিয়ে প্রভাবশালী নেতার ক্ষমতাধর কর্মীরা যা খুশী তাই বলে যাচ্ছে। এমনটাই মনে করেন জেলার সচেতন মহলের লোকজন।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকা স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল গত মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সন্ধ্যায় নগরীর চানমারী এলাকায় নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রির কার্যালয়ে তার সভাপতিত্বে আসন্ন রমজান উপলক্ষে দোকান মালিক ও পরিবহন শ্রমিক মালিকদের আয়োজিত একটি সভায় ক্রীড়া সংগঠক তানভির আহম্মেদ টিটু ও কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলকে নিয়ে ষড়যন্ত্র বন্ধ করা না হলে বাস, ট্রাক, দোকানপাট বন্ধ করে দেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। ওই সময় চেম্বার সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, এ সময়ের মধ্যে যদি ক্ষমা চাওয়া না হয় তাহলে সমস্ত দোকানপাট, বাস, ট্রাক সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হবে। তিনি বলেন, তানভীর আহম্মেদ টিটু পরপর দুইবার চেম্বারের পরিচালক ছিলেন, একজন ভদ্র ছেলে হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। অথচ তাকে ন্যাক্কারজনকভাবে মদ ব্যবসায়ী বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ভদ্রকে অভদ্র বানানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সজল একজন জনপ্রিয় নেতা, তাকেও কিডন্যাপার বানানো হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
বিপরীতে তার ঠিক পরদিনই নারয়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ রাস্তায় নেমে আসেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মাঝে মাঝেই নগরী পরিদর্শন করতে আসি। আজকের পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হলো, ফুটপাত পরিষ্কার আছে কিনা তা দেখা। দেখলাম ফুটপাত পরিষ্কার আছে সেই সাথে জণগন হাটাচলা করতে পারছে। ডিসি সাহেব যদি ম্যাজিষ্ট্রেট দেন, সিটি কর্পোরেশন যদি ম্যাজিষ্ট্রেট দেন তাহলে আমাদের কাজগুলো আরও সহজ হয়ে যাবে। আমরা যতটুকু পারছি ফুটপাত হকারমুক্ত রাখার চেষ্টা করছি। ভাষা সৈনিক সড়ক, বঙ্গবন্ধু সড়ক, লিংক রোড পরিষ্কার রাখার জন্য আমাদের এই অভিযান।
এসপির ওই বক্তব্যের প্রদানের পরেও জেলার রাজনৈতিক বোদ্ধামহল মনে করেন, পুলিশ সুপার ফুটপাত পরিদর্শন করতে আসলেও তার মূল উদ্দেশ্যে ছিলো প্রশাসনকে ঘিরে যারা বক্তব্য প্রদান করেছে সেই সাথে শহর অচল করে দেয়ার হুঙ্কার দিচ্ছে তাদের দেখতে আসা। তাদের মতে, বর্তমান পুলিশ সুপার নারায়ণগঞ্জে থাকাকালীন যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিদ্বয় হোক না কেন কোন লাভ হবে না। শহর অচল করা তো দূরে থাক অবৈধভাবে কোন কাজ করতে দেবেন না বর্তমান এসপি। কারণ তিনি কোন ভাইয়ের তোয়াক্কা করেন না। তিনি তার গতিতে ছুটে চলেছেন এবং তিনি সফল হবেন।
এসপি হারুন যোগদানের পরপরই সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা প্রদান করেন যে, কোন ভাইয়ের কথায় কাজ হবে না। অপরাধ যে করবে শাস্তি সে পাবে। সে যেই হোক না কেন। কোন ছাড় দেয়া হবে না। অপরাধ করবেন আর বলবেন যে আমি ওই ভাইয়ের লোক এই ভাইয়ের লোক তা হবে না। অপরাধীদের সঙ্গে কোন আপোষ নয়।
এসপির ঘোষণার ধারাবহিকতায় প্রথমেই তিনি জেলার বেশ কিছু অবৈধ স্ট্যান্ড রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর নগরীর মানুষ যাতে ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে নগরীর ফুটপাত উচ্ছেদের ঘোষণা দেন তিনি। জানা যায়, ওইসকল অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা নেতারা। কিছু দিন আগে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজামের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেন সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের। এর পরপরই ফতুল্লা থানা থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়। পুলিশ সুপারের নির্দেশে অভিযান চালানো হয় পাগলার ভাসমান মেরিআন্ডারসন বারে। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকসহ প্রায় ৭০ জন মাদকসেবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মাদকসেবীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা যায়, ওই মাদকের আস্তানা নিয়ন্ত্রণ করেন সঞ্জয়। ওই সঞ্জয় সাংসদ শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করে। টিটু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করে মেরিআন্ডারসনে সরবরাহ করে থাকেন। এসপির এসকল কর্মকান্ডে উপরোক্ত নেতাকর্মী ছাড়াও প্রভাবশালী ছত্রছায়ায় থাকা অসংখ্যা নেতাকর্মীদের প্রায় ঘুম হারাম হয়ে যায়। যার ন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেন তারা। সম্প্রতি শহর অচলও করে দেয়ার হুশিয়ারী প্রদান করেন স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান খালেদ হায়দার খান কাজল। তার এই হুঙ্কারে নগরবাসীর মনে আতঙ্ক বিরাজ করে।
অন্যেিদক, মাদক, সন্ত্রাস ও অবৈধ কর্মান্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসনের এরুপ তৎপরতায় প্রভাবশালী ছত্রছায়ায় থাকা বেশ কিছু নেতাদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কর্মীদের সাত্বনা সেই সাথে যেকোন নির্দেশ দিতে গতকাল শনিবার জরুরী কর্মীসভার আয়োজন করা হয়। অনেকেই অধীর আগ্রহে বসেছিলেন যে কী বলবেন শামীম ওসমান। তবে স্বাভাবিকভাবে যা বলার কথা তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রশাসনকে হুশিয়ারী প্রদান করা সহ এক হাত নিয়ে নেন শামীম ওসমান।
জরুরী সভায় শামীম ওসমান বলেন, কেউ যদি মনে করেন কাউকে ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জের শান্তিপূর্ণ অবস্থা নষ্ট করবেন, তা হবে না। এখানে যারা ব্যবসা করে তারা বিদেশী না এখানকার স্থানীয়। আমাদের ভাই ব্রাদার। এখন তাদেরকে কেউ ফোন করে বলবেন, দেখা করেন। আমি বলবো দেখা করার সময় শেষ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। নিজামের বিরুদ্ধে জিডি হইসে, টিটুর বিরুদ্ধে মামলা হইসে, সজলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। কর্মীরা ভয়ে থরথর করে কাপঁছে, আমরা ভয় পেয়েছি আমরা ভীত? না কখনোই না। যুবলীগ, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সৈনিক। আমরা কাউকে ভয় পাইনা। কেউ যদি খেলতে চান, ডোন্ট প্লে, নারয়ণগঞ্জে খেইলেন না। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করবে তাদের জুয়ার মামলার আসামী বানায় দিবেন? আমার আতœীয় স্বজনদের মদের সাপ্লায়ার বানায় দিবেন? কাবু করতে চান? ওইসব কইরেন না। আমাগো কাবু করা যাবে না। অপেক্ষা করেন, আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যেই টের পাবেন। কেউ যদি মনে করেন, নারায়ণগঞ্জে এই কাউন্সিলরকে ফাঁসাবো, ওর থেকে চাঁদাবাজি করবো। ওটা কইরেন না।
শামীম ওসমান আরও বলেন, আমাকে আমার কর্মীরা তলব করেছে যে নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা প্রচন্ডভাবে উত্তেজিত। বাদল, খোকন সাহা আমাকে বলেছে। নারায়ণগঞ্জে পরিস্থিতি নাকি অনেক জটিল। আমার নেতাকর্মীরাও দেখলাম উত্তেজিত, ঠিকই আছে। আপনাদের মতো বয়সে আমরাও উত্তেজিত ছিলাম। আল্লার রহমত যে আমি ২০১১’র শামীম না। বয়স ও বাড়ে সেই সাথে ধৈর্যও বাড়ে। বিষয়টা কী? যারা এসছেন হঠাৎ করে বিদেশী মেহমান হয়তো কারও খেলাতে পা দিয়ে দিয়েছেন। কখন থেকে এই খেলা শুরু হলো? আমি কারও নাম বলবো না। এগুলারে আমি গনায় ধরি না। চন্দনশীল, খোকন, বাদল আমাকে বললো আমরা তো সরকার দলীয় লোক তাই আমাদের হাত-পা তো বাধা। আমি বললাম, তো কী করতে চান? হাত-পা খুলতে চান। ঠিকাছে, হাত পা খুলে দেখি যে নারায়ণগঞ্জের বেডা টা কে? বিষয়টা আপনারা চান আমি জানি। কিন্তু এত তারাতারি কাউরে ভুল বুইঝেন নাহ। যা দেখতেছেন তা না। পর্দার অন্তরালে কিছু খেলা থাকে। সেই খেলায় কেউ কেউ ভুল করে পাড়া দেয়।
গতকার শামীম ওসমানের জরুরী সভা চলাকালীন পুরো শহর যেনো ফাঁকা হয়ে যায়। যে শহরে সবসময় মানুষের পদচারণা ও গাড়ীর কারণে যানজট লেগে থাকে সেই শহরে কোন মানুষই লক্ষ্য করা যায়নি গতকাল। ওই জরুরী সভা চলাকালীন সময় শহরজুড়ে থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শামীম ওসমান ও তার কর্র্মীদের হুশিয়ারীতে নগরবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তবে এখনো শহর জুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।